এনটিআরসিএ’র দূর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিবে সিলেটের শিক্ষার্থীরা
আখলাক হুসাইন, সিলেট জেলা প্রতিনিধিঃ
গত ৪ জুন বুধবার ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ফাইনাল রেজাল্ট প্রকাশ করে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ এনটিআরসিএ। ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৮১,২০৯ জন। ভাইভা পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয় ৬০,৫২১ জন এবং অকৃতকার্য হয় মোট ২০,৬৮৮ জন প্রার্থী। এনটিআরসিএ’র ইতিহাসে এই প্রথম এতো বড় সংখ্যক প্রার্থী ভাইবা থেকে ছিটকে পড়ল। এতে করে এনটিআরসিএ’র কর্তৃপক্ষের উপর অভিযোগ উঠছে দূর্নীতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের। এই ২০ হাজার প্রার্থী ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন আন্দোলনের জন্য। আগামী ১৫ জুন রবিবার এনটিআরসিএ’র অফিসের সামনে বিশাল জমায়েতের ডাক দিয়েছেন তারা। এর আগে ১১জুন বুধবার তারা সংবাদ সম্মেলন করবেন। পাশাপাশি আইনী লড়াইয়েরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। এই আন্দোলনে যোগ দিবেন সারা দেশ থেকে আগত অকৃতকার্য প্রার্থীরা। সেই ধারাবাহিকতায় সিলেট থেকে অংশগ্রহণ করছেন অকৃতকার্য প্রার্থীদের বড় একটি অংশ। জানা যায় ভার্চুয়ালি যোগাযোগ রক্ষা করে এই কমিউনিটি গড়ে উঠছে।
উল্লেখ্য, গত ২নভেম্বর ২০২৩ সালে ১৮-তম শিক্ষক নিবন্ধনের সার্কুলার প্রকাশিত হয়। আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল -১৮,৬৫,৭১৯ জন, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক আবেদন রেকর্ড। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞান এই চার বিষয়ে মোট ১০০ নাম্বারের এমসিকিউ পরীক্ষা হয়। গত ১৫মার্চ, ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত এই পরীক্ষায় মোট ১৩ লাখ ৪০ হাজার ৮৩৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ জন উত্তীর্ণ হন, যা গড়ে ৩৫.৮০ শতাংশ পাসের হার নির্দেশ করে।
১২ ও ১৩ জুলাই ২০২৪ সালে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত পরীক্ষায় হঠাৎ সিলেবাস পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ নতুন সিলেবাস করা হয়। পরীক্ষার প্রশ্নে বিকল্প অপশন বাদ দেয়া হয়। ১৪ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল। লিখিত পরীক্ষায় মোট ৩,৪৮,৬৮০ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিলেন, যার মধ্যে ৮৩,৮৬৫ জন উত্তীর্ণ হন। ২৭ অক্টোবর ২০২৪ সাল থেকে শুরু হয়ে ২৯ মে ২০২৫ সালে (৭ মাস ধরে) মোট ৮ ধাপে ভাইভা শেষ হয়।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ গণবিজ্ঞপ্তিতে মোট ১,০০১৪২ টি ( এক লক্ষ একশত বিয়াল্লিশটি) শূন্য পদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
এনটিআরসিএ’র দায়িত্বই হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদ পুরণ করা। আর এজন্যেই নিবন্ধন পরীক্ষা নেয়া হয়।
যেখানে লক্ষাধিক শূন্য পদ রয়েছে সেখানে লিখিত পাশ করানো হয়েছে ৮৩ হাজার ৮৬৫ জন।
সাংবিধানিক নীতি ও যোগ্যতার বিচারে এই ৮৩ হাজার লিখিত উত্তীর্ণ সকলেই শিক্ষক হবার অধিকার রাখে। অতীতের প্রত্যেকটা পরীক্ষায় এমনটাই হয়েছিল। যারা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল তাদের সবাইকেই সনদ দিয়েছিল। সার্টিফিকেট ও নামগত ত্রুটির কারণে কেউ কেউ ভাইভায় অনুত্তীর্ণ হয়েছিল।
অতীতের সব নিয়মের বাইরে গিয়ে এবার ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনে ২০ হাজারের অধিক ক্যান্ডিডেটকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে ভাইভায় ফেইল করিয়ে দেয়া হয়, যাতে এনটিআরসিএ’র বৈষম্য, দূর্নীতি ও প্রহসন স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়ে যায়।
এনটিআরসিএ’র ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের ভাইবা পরীক্ষার ফলাফল কেন প্রশ্নবিদ্ধ এটাকে অনেক ভাবে বিশ্লেষণ করছেন অনেকে। নিচে কয়েকটি বিশ্লেষণ তোলে ধরা হলো;
১। নীতিমালা লঙ্ঘন:
সার্কুলারে উল্লেখ ছিল পাশের জন্য লিখিত ও ভাইভায় মিনিমাম ৪০% শতাংশ নাম্বার পেতে হবে। ভাইভাতে ২০ নাম্বারের মধ্যে ১২ সার্টিফিকেট থেকে আর ৮ উপস্থিতি, পোশাক, ও জিজ্ঞাসাবাদ থেকে।
উভয়টিতে আলাদাভাবে ৪০% পেয়ে পাশ করতে হবে। কিন্তু ১৮তম ভাইভাতে উপরোক্ত নীতি ভঙ্গ করা হয়েছে। ৪০% নাম্বার পাওয়াতেই লিখিত পাশ করা হয়েছে। ভাইভাতে ৪০% না পাওয়াটাই প্রায় অসম্ভব। কারণ ২০ নাম্বারের মধ্যে ১২ নাম্বার তো সার্টিফিকেট থেকেই পাওয়া যায়। এই ১২ নাম্বারের ৪০% সবাই পাবে। বাকী ৮ নাম্বারের ৪০% অর্থাৎ ৩.২ নাম্বার উপস্থিতি ও পোশাক থেকেই পাওয়া যায়, প্রশ্নোত্তর তো আছেই।
২। ৮ নাম্বারের মধ্যে মাত্র ৩.২ নাম্বার না পাওয়ার অযুহাতে যোগ্যদের ফেইল করানো:
১৮ লক্ষ ক্যান্ডিডেট থেকে যারা প্রিলি পাশ করে লিখিত পরীক্ষার জন্য সিলেক্টেড হয়েছে তারা অবশ্যই যোগ্য। এরপর নতুন সিলেবাসে, প্রশ্নে বিকল্প অপশন ছাড়াই যারা লিখিত পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে তারা মাত্র ৪ নাম্বারের মৌখিক পরীক্ষায় অন্তত ২/১ পাবে না এটা অবিশ্বাস্য ও অযৌক্তিক। মাত্র ৮ নাম্বারের মৌখিক পরীক্ষায় ৩.২ নাম্বার পাবে না? ২০ হাজার ফেইল ক্যান্ডিডেট ভাইভাতে যদি ৮ এর মধ্যে ২/৩ নাম্বার না পায়, তবে তারা প্রিলি, লিখিত কেমনে পাশ করলেন? এরা প্রত্যেকেই অনার্স, মাস্টার্স, প্রিলি, লিখিত পাশ করেই মাত্র ৮ নাম্বারের মৌখিক পরীক্ষা দিতে গিয়েছে।
৩। পূর্ববর্তী রেকর্ড ভিন্ন:
একটু অতীতে যদি ফিরে দেখি। ১৭ তম নিবন্ধনের ভাইভা দিয়েছে ২৬ হাজার ২৪৩ জন। এর মধ্যে ২,২৫৭ জনের সার্টিফিকেটজনিত ত্রুটির কারণে ফেইল আসছে, বাকী সবাইকে পাশ দেয় হয়েছে।
১৬ তম নিবন্ধনে ১৮,৫৫০ জন ভাইভা দিয়েছে, ১৮,৫৫০ জনকেই পাশ করানো হয়েছে। কাউকে ফেইল দেয়া হয়নি।
১৫ তম নিবন্ধনে ১৩ হাজার ৩১৩ জন ভাইভা দিয়েছে। ১৩ হাজার সবাই পাশ করেছে। সার্টিফিকেটজনিত ত্রুটির কারণে ৩০০ জন বাদ পড়েছিল।
১৪ তম নিবন্ধনে ভাইভা দিয়েছে ১৯ হাজার ৮৬৩ জন। ভাইভা পাশ করেছে ১৮ হাজার ৩৪২ জন। সার্টিফিকেটজনিত কারণে এক হাজার বাদ পড়েছে।
এভাবে অতীতের সব নিবন্ধনে ভাইভায় এত সংখ্যক ক্যান্ডিডেট ফেইল করায়নি যত সংখ্যক ক্যান্ডিডেট ১৮তম নিবন্ধনে ফেইল করানো হয়েছে। এর পেছনে ষড়যন্ত্র ও দূর্নীতির সমূহ সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন বিশ্লেষক। এনটিআরসিএ-তে গাপটি মেরে বসে থাকা লোকদের মাধ্যমে অযৌক্তিকভাবে ফেইল দিয়ে ২০ হাজার পরীক্ষার্থীকে আন্দোলনে নামিয়ে দিয়ে ইন্টারিম গভর্ণমেন্টকে চাপে ফেলানোর সুক্ষ্ম কৌশল বলে অনেকেই ধারণা করতেছে।
৪। নিবন্ধন পাস মানেই চাকরি নয়; ফলে অন্যান্য পরীক্ষার সাথে তুলনা করা যাবে না:
যারা বলে প্রতিটি পরীক্ষায় পাশ ফেইল আছে, তাই ফেইল মেনে নেয়া উচিত। তাদের জানা উচিত নিবন্ধন পরীক্ষা আর অন্য চাকরির পরীক্ষা এক নয়। অন্য চাকরির পরীক্ষায় ভাইভা পাশ মানেই চাকরি কিন্তু নিবন্ধনের ভাইভা পাশ মানেই চাকরি নয়। এটা কেবল সনদ প্রদান। তাও এর মেয়াদ মাত্র ৩ বছর।
মূলত শূন্যপদের বেশি সনদধারী থাকলে প্রাপ্ত নাম্বারের র্যাংক অনুযায়ী চাকরি হয়। অন্য পরীক্ষায় মাত্র ৮ নাম্বারের ভাইভা হয় না। যেখানে ৩.২ পেলেই পাশের নীতিমালা আছে।
৫। ভাইভা বোর্ডে অনিয়ম:
৭ মাস ধরে চলাকালীন ভাইভা বোর্ডে অনভিজ্ঞ টিচার দিয়ে ভাইভা নেয়া হয়েছিল। এদের মূল্যায়ন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কাউকে একটা প্রশ্ন করেই পাশ করিয়ে দিয়েছে আবার কাউকে ১০ টা প্রশ্ন করেই ফেইল করিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় অনিয়ম, বৈষম্য ও দূর্নীতি হয়েছে ভাইভা বোর্ডে। কাউকে এক মিনিট প্রশ্ন করেছে আবার কাউকে ১০মিনিট প্রশ্ন করেছে।
একজন প্রার্থী তার এক ফেসবুক পোস্টে লিখেন “আমি সার্টিফিকেটে পূর্ণ ১২ মার্কস পেয়েছি। এদিকে আমার পোশাক ছিল ফর্মাল এবং পরীক্ষক বোর্ডের সাথে আমার একটি মাত্র প্রশ্নোত্তরের লেনদেন হয়েছিল। তারা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন আমি কি ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম? আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আমি প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলাম। এরপর উনারা বললেন, আপনি আসতে পারেন। আমি সালাম বিনিময় করে চলে আসলাম। আমার ভাইবায় ফেল আসলো! তাহলে কি ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকাটা আমার অন্যায় ছিল?
একজন প্রার্থী তার এক ফেসবুক কমেন্টে প্রশ্ন রাখেন, এনটিআরসিএ’র নিয়ম অনুযায়ী ৪০℅ মার্কস পেলে প্রার্থী পাশ করবে। এখন আসুন, ভাইবা বোর্ডে মার্কস হলো ২০। এটা আবার তিন ভাগে বিভক্ত। সার্টিফিকেটস এর ওপর ১২ নম্বর, ড্রেসাপের উপর ৪ নম্বর এবং প্রশ্ন-উত্তর পর্বে ৪ নম্বর। যেহেতু শিক্ষা জীবনের যেকোনো একটি সার্টিফিকেটে তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য সুতরাং এই ভিত্তিতে সার্টিফিকেটসে ৭ নম্বর পেলে কোন প্রার্থী পাস করতে পারে। বাকি থাকল ৮ মার্কস। এমন কোন প্রার্থী নেই যে ভালো পোশাক পরিচ্ছেদ পরে যাবে না। সুতরাং চার মার্ক সে অবশ্যই পেয়ে যাবে। অথচ ৮ মার্কস এর ৪০% হলো ৩.২। সুতরাং পাশ করার জন্য কোন প্রার্থীকে মাত্র ১০.২ নম্বর পেলেই যথেষ্ট। অথচ অধিকাংশ প্রার্থী যারা ফেল করেছে তারা সার্টিফিকেটের পুরো ১২ নম্বর পেয়েছে এবং আগেই বলেছি কারো ড্রেসাপ খারাপ ছিল না। সুতরাং ড্রেসাপের ৪ নম্বর না পেলেও ৩নম্বর তো পাওয়া উচিত? তাহলে তার মোট নম্বর দাড়াল ১৫। এরপরও এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যে অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাকে ১৫টি প্রশ্ন করা হয়েছিল। আমি ২টির উত্তর দিতে পারিনি। এখন প্রশ্ন হলো কোন দিক বিবেচনায় আমি ফেল করলাম?