“ময়মনসিংহে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন,কে পাচ্ছেন মনোনয়ন? আলোচনায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা”
আবুল কালাম আজাদ, ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি:
ময়মনসিংহ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ময়মনসিংহ-১ ও ময়মনসিংহ-২ আসনে ভোটের আলাপ এখন সর্বত্র। গণঅভ্যুত্থানের পর এটিই প্রথম জাতীয় নির্বাচন, সে কারণে এই দুই আসনকে রাজনৈতিক দলগুলো ‘মুড ইনডিকেটর’ হিসেবে দেখছে। দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক শক্তির কারণে বিএনপি এগিয়ে থাকলেও তৃণমূলে দলের কোন্দল বিদ্যমান। অন্যদিকে জামায়াতের চলছে বিরামহীন গণসংযোগ। ফলে আসন দুটিতে রাজনীতির মাঠ এখন গরম।
ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া)
হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলাকে নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-১ । এই আসন পাহাড় ও বনঘেরা দুর্গম ভূপ্রকৃতি, অভ্যন্তরীণ সীমান্তপথ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত বিস্তৃত জনপদ। সব মিলিয়ে এই আসন রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সংবেদনশীল। আনুমানিক ৩৫ হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভোটার ঐক্যবদ্ধভাবে অবস্থান নিলে ফল নির্ধারণে তারা প্রায়ই নির্ধারক হয়ে ওঠেন। যোগাযোগব্যবস্থা, পাহাড়ি সড়ক সংস্কার, হাট-বাজার আধুনিকায়ন, স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট ও আবাসনের মতো ইস্যুতে তৃণমূলে প্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকার করতে হবে প্রার্থীদের।
বিএনপির ভেতরে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে তিনটি মুখ সবচেয়ে আলোচিত সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, আফজাল এইচ খান ও সালমান ওমর রুবেল। প্রিন্স দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব; দুঃসময়ে রাজপথে থাকার ত্যাগী ইমেজ ও ধারাবাহিক মাঠে উপস্থিতির কারণে তৃণমূলে তার গ্রহণযোগ্যতা দৃঢ়। হালুয়াঘাট-ধোবাউড়ার বহু ইউনিট কমিটির দায়িত্বশীলদের তিনি প্রভাবিত করতে সক্ষম। নিয়মিত পথসভা, মতবিনিময় ও সাংগঠনিক বৈঠক তাকে মনোনয়ন দৌড়ে সামনের সারিতেই রাখছে। আফজাল এইচ খান দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও প্রয়াত টিএইচ খানের রাজনৈতিক উত্তরসূরি। তবে অতীতের একাধিক নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেও জয় ধরা দেয়নি। তৃণমূল বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে তার উপস্থিতি কম ছিল। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি সভা-সেমিনারে যোগ দিয়ে ফের সক্রিয় হয়েছেন।
পারিবারিক ঐতিহ্য, পুরোনো নেটওয়ার্ক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাকেই নিজের শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। সালমান ওমর রুবেল তুলনামূলক তরুণ। করোনাকালে ত্রাণ, চিকিৎসা সহায়তা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তিনি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং তরুণ ভোটারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধন তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। তার সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি একাধারে ক্লিন ইমেজ, দরিদ্র-অসহায়দের পাশে থাকা ও নিয়মিত গণসংযোগ তাকে বিতর্কের বাইরে রেখেছে। তাছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত ওমর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও আর্থিক সহায়তায় বিগত সময়গুলোতে বিনামূল্যে চক্ষু ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মাধ্যমে হাজার হাজার রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা ও বিনামূল্যে চোখের ছানি সম্পন্ন করা হয়। চোখের অপারেশনের জন্য সব ধরনের ওষুধ ও থাকা-খাওয়ার যাবতীয় খরচ বহন করে ওমর ফাউন্ডেশন। এজন্যও নিজ এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি।
বিএনপির এই তিন নেতার কর্মসূচি আলাদা ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয়। আফজালপন্থিরা অভিযোগ তুলছেন। উপজেলা বিএনপির কমিটিতে প্রিন্সপন্থিদের একচেটিয়া আধিপত্য আছে, এমনকি বিরোধী ঘরানার লোক ঢুকে পড়ার কথাও তারা বলছেন। দায়িত্বশীলরা সেটিকে ভিত্তিহীন অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকায় কিছু পক্ষ স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব হারিয়েছে। রুবেলপন্থিরা প্রকাশ্য বিরোধে না গিয়ে স্বল্পসংখ্যক কর্মী নিয়েই মাঠ চষছেন। এই ত্রিমুখী অনৈক্য দীর্ঘস্থায়ী হলে ভোটযুদ্ধে প্রভাব ফেলতে পারে বলে শঙ্কা তৃণমূলের।
বিএনপির অনৈক্যের মধ্যেই জামায়াতে ইসলামী এ আসনে ধারাবাহিকভাবে মাঠে কাজ করে যাচ্ছে। দলের মনোনীত প্রার্থী মাহফুজুর রহমান মুক্তা ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি। তিনি সকাল-বিকাল হাট-বাজার, গ্রাম-চৌমাথা, মসজিদ-মাদরাসা সবখানেই নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছেন। পরিবারভিত্তিক ছোট বৈঠক, পেশাজীবী-যুবসমাজকে লক্ষ্য করে ‘সুশাসন, মাদক-দমন, ন্যায্য বাজার’ ধরনের বার্তা তাকে দৃশ্যমান অগ্রগতি এনে দিয়েছে। বিএনপির তৃণভাগের একাংশ স্বীকার করছে, তাদের মধ্যে গ্রুপিং থাকায় জামায়াতে ইসলামী বেশিসংখ্যক ভোটারকে কাছে টানার সুযোগ পাচ্ছে।
জামায়াতের পাশাপাশি ইসলামপন্থি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তৎপরতাও সমীকরণে নতুন বার্তা যোগ করেছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান দুই উপজেলায় ধারাবাহিক সভা–সেমিনারে অংশ নিচ্ছেন। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়ে গ্রামগঞ্জে ঘুরছেন; এনসিপির সাইফুল্লাহ মোটরসাইকেল শোডাউনে তরুণদের দৃষ্টি কাড়ছেন। গণঅধিকার পরিষদ ও খেলাফত মজলিস থেকেও প্রার্থী দেওয়ার গুঞ্জন রয়েছে। শেষ মুহূর্তে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া হলে বিএনপির বিভক্ত ভোট ব্যাংকের ওপর সরাসরি চাপ পড়বে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভোট এখানে নীরব; কিন্তু জয় নির্ধারণকারী শক্তি। গারো, হাজংসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ শিক্ষা-স্বাস্থ্য, ভূমি-বনসম্পদ ব্যবহারের অধিকার এবং চাকরি-কোটা সংক্রান্ত বাস্তব সমস্যায় দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কথা বলেন। তারা সাধারণত নির্বাচনের আগ মুহূর্তে অর্থাৎ শেষ সপ্তাহে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেন। যে দল আদিবাসীদের বাসস্থান, পাহাড়ি রাস্তা-সেতু সংস্কার, পাহাড়ি কৃষির জন্য স্বল্পসুদে ঋণ ও বনজ-ফলদ ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মতো বাস্তব অঙ্গীকার উপস্থাপন করবে, তাদের দিকেই ভোট ঝুঁকতে পারে। সে কারণেই প্রধান প্রার্থীরা পাহাড়ি গ্রামগুলোতে ‘লিসেনিং সার্কেল’ চালু করেছেন, প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন।
গারো সম্প্রদায়ের এক প্রবীণ নেতা বলেন, কে উন্নয়নের কথা লিখিতভাবে দেয় সেটাই দেখা হবে এবং তারপর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত। কৃষক আব্দুল মজিদ সরলভাবে বলেন, এলাকায় কাজের এমপি দরকার।